প্রায় দেড়শ কোটি ভারতীয়র স্বপ্নকে চুরমার করে রেকর্ড ষষ্ঠ বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জিতলো অস্ট্রেলিয়া। ট্রাভিস হেড নামক এক অজির কাছে ভেঙেছে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন। ফাইনাল ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন ট্রাভিস হেড। ইতিহাসের ষষ্ঠ ব্যাটার হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে সেঞ্চুরি করলেন তিনি। এর আগে বিশ্বকাপের ফাইনালে সেঞ্চুরি করেছেন ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, অরবিন্দ ডি সিলভা, রিকি পন্টিং
প্রতিটা ম্যাচ একতরফা খেলে ফাইনালে আসে ভারতে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফেভারিট ছিল তারাই। ক্রিকেট বিশ্লষকদের বেশিরভাগই ভারতের পক্ষে বাজি ধরেছিলেন। কিন্তু ফাইনালে সব অনুমানকে ভুল প্রমাণ করেছে অস্ট্রেলিয়া। ভারতকে ৬ উইকেটে হারিয়ে আট বছর পর আবারও বিশ্বকাপের শিরোপা পুনরুদ্ধার করলো অজিরা।
ফুটবলে ব্রাজিল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়াও এতোদিন ছিল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু আজ থেকে তাদের নামের পাশে লেখা থাকবে ছয়বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ২০ বছর আগে বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল ভারত। কিন্তু সেই স্বপ্ন তাদের স্বপ্নই রয়ে গেল।
দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ভারতীয় ব্যাটাররা শিরোপার মঞ্চে আর সেই ছন্দ ধরে রাখতে পারলেন না। স্বল্প পুজি নিয়ে তাই লড়াই করা হলো না ভারতীয় বোলারদের। ভারতের ২৪০ রানের জবাবে ৪২ বল হাতে রেখেই ফাইনাল জিতে নিল অস্ট্রেলিয়া।
কোন দলকেই পাত্তা না দেওয়া ভারতীয় দলের ব্যাটিং অবশেষে মুখ থুবড়ে পড়লো ফাইনাল ম্যাচে এসে। বিশ্বকাপের সব ম্যাচেই দাপুটের সাথে জয়ে ফাইনালে এসেছে ভারত। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ উড়িয়ে দেবে অস্ট্রেলিয়ার বোলিংকে।
টস হারার পরও ভারত যখন প্রথমে ব্যাট করার সুযোগ পায় তাতে বেশ খুশিই হয়েছিল ভারতীয় সমর্থকরা। তাদের আশা ছিল ভারতের ব্যাটারদের ব্যাটিং ঝড় দেখতে পাবেন তারা। টসের পর ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মাও জানিয়েছিলেন টস জিতলে ব্যাটিংই নিতেন তিনি। অর্থাৎ বিশ্বকাপের ফাইনালের শুরুতেই ভারতের চাওয়া পূরণ হয়েছে। কিন্তু আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে উপস্থিত এক লাখ ৩০ হাজার ভারতের দর্শককে রোহিতদের ব্যাটিংয়ের বেশির ভাগ সময় নিশ্চুপ থাকতে দেখা গেছে। ইনিংসের একটা সময় ৯৭ বল খেলে কোন চার বা ছয় মারতে পারেনি ভারতের ব্যাটাররা।
সাড়ে তিনশ বা চারশ রানের কাছাকাছি যাওয়া ভারতের কাছে যা ভিডিও গেমসে খেলার মতো ব্যাপার সেখানে ফাইনালের বাইশ গজে কি সংগ্রামই না করতে হয়েছে তাদের ব্যাটারদের। আর তাই প্রথমে ব্যাট করে আড়াইশ রানও জমা করতে পারেনি ভারত। অধিনায়ক রোহিত শর্মা অবশ্য তার স্বাভাবিক খেলাটাই খেলেছেন। আর তাই ৪ রান করে শুভমন গিল আউট হলেও উড়ন্ত সূচনা পায় ভারত। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের উপর বেশ চড়াও হয়ে ব্যাট চালান রোহিত শর্মা। রোহিত আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠার আগেই তাকে থামিয়েছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ট্রাভিস হেডের দারুণ এক ক্যাচে ৩১ বলে ৪৭ রান করে আউট হয়েছেন ভারতের অধিনায়ক। ভারতের পুরো ইনিংসে আজ তিনটি ছক্কা ছিল। আর তিনটিই রোহিত শর্মার। শ্রেয়াস আয়ার ৪ রানে আউট হলে ২ উইকেটে ৭৬ থেকে মুহূর্তেই ৩ উইকেটে ৮১ হয়ে যায় ভারত। অস্ট্রেলিয়ার পেস অ্যাটাক বেশ সমস্যায় ফেলে ভারতীয় ব্যাটরদের।
দলের প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দেন বিরাট কোহলি ও লুকেশ রাহুল। ১০৯ বল খেলে ৬৭ রান করেন তারা। ভারতের ইনিংসে এটিই সর্বোচ্চ রানের জুটি। হাফ সেঞ্চুরি করেন কোহলি ও রাহুল দু’জনই। ৫৪ রান করেন বিরাট কোহলি। আর ৬৬ রানে আউট হয়েছেন লুকেশ রাহুল। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি ও লুকেশ রাহুল ছাড়া অন্য কোন ব্যাটার ফাইনাল ম্যাচে দাঁড়াতে পারেনি। ঠিক ৫০ ওভারে ২৪০ রানে অলআউট হয় তারা।
অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক ৫৫ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট। জশ হ্যাজেলউড ও প্যাট কামিন্স ২টি করে উইকেট নেন। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের ১০ ওভারে ভারতের কোন ব্যাটার চার বা ছয় মারতে পারেনি। এবারের বিশ্বকাপে কোন পেসার এই প্রথম এমন কৃতিত্ব দেখালেন।
২৪১ রানের টার্গেট সহজ মনে হলেও শুরুতেই চাপে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। ৪৭ রানের মধ্যেই ৩ উইকেট তুলে নেন ভারতের দুই পেসার মোহাম্মদ শামী ও জাসপ্রিত বুমরাহ। বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের প্রধান অস্ত্র মনে করা হয়েছিল মোহাম্মদ শামীকে। আগের ছয় ম্যাচে ২৩ উইকেট নিয়ে ভারতের আশা ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেন তিনি। নিজের প্রথম ওভারেই উইকেট পেয়ে ভারতীয়দের আশা আরও বাড়িয়ে দেন শামী। দলীয় ১৬ রানে ডেভিড ওয়ার্নারকে আউট করেন মোহাম্মদ শামী। পরের দু’টি উইকেট পেয়েছেন বুমরাহ। মিচেল মার্শ ও স্টিভেন স্মিথকে আউট করেছেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার এই বিপদে হাল ধরেন ট্রাভিস হেড ও মার্নাস লাবুশানে। এই দু’জন মিলে দলীয় সংগ্রহ একশ পার করেন। লাবুশানে ধীর গতিতে ব্যাট করলেও আক্রমণাত্নক ছিলেন ট্রাভিস হেড। ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নকে আস্তে আস্তে দূরে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। ৯৫ বলে সেঞ্চুরি করে ভারতকে উপহার দিয়েছেন দুঃস্বপ্নের রাত। কোন বোলারই আজ পাত্তা পায়নি ট্রাভিস হেডের কাছে। ভারতের ১১ ব্যাটার মিলে চার মেরেছেন ১৩টি আর ছয় ৩টি। ট্রাভিস একাই ছাড়িয়ে গেছেন ভারতের সবাইকে। তার ইনিংসে ছিল ১৫টি চার ও চারটি ছয়ের মার। বিশ্বকাপ জিততে অস্ট্রেলিয়ার যখন দুই রান দরকার তখন ১২০ বলে ১৩৭ রানে আউট হয়েছেন ট্রাভিস হেড।
ট্রাভিসকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন মানার্স লাবুশানে। ঠান্ডা মাথায় দেখেশুনে খেলে ৯৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেন তিনি। ৫৮ বলে অপরাজিত থাকেন। ৪৩ ওভারে ৪ উইকেটে ২৪১ রান করে ষষ্ঠ বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলে অস্ট্রেলিয়া।