২৬ মে, ২০২৪। তারিখটি কলকাতার জন্য স্মরনীয় হয়ে থাকবে। বলা যেতে পারে মে মাসের এই শেষ দশটা দিনই হয়তো ২০২৪ সালের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন হতে যাচ্ছে অর্জনের মানদণ্ডে। এক তো কান চলচ্চিত্র উৎসবে কলকাতার নির্মাতার বিজয়, আরেক দিকে ১০ বছর পর কলকাতা নাইট রাইডার্স তথা কেকেআরের আইপিএল খেতাব জয়!
মাঠজুড়ে যখন আনন্দ উৎসব তখন চোখে পড়ে একটি হাসিমুখ যিনি তার নাম ও গোমড়ামুখের জন্যেই বেশি চোখে পড়তেন। কেকেআরের মেন্টর তথা গুরু গৌতম গম্ভীর তার নামের বিপরীতে গিয়ে অবশেষে হাসলেন।
গৌতমের ফির আসার পর ফের আইপিএল জয় অনেক গল্পই সামনে নিয়ে আসে। মাঝে দুই বছর লক্ষনৌর দলের জন্য খেলেছেন বটে। তবে কলকাতার দল তার কাছে অন্যরকম।
গৌতমকে ২০১১ সালে দলে টেনে নেবার সময় কেকেআরের অন্যতম মালিক শাহরুখ খান বলেন, ‘আমাকে অভিনয় নিয়ে কেউ শিখাতে আসলে আমার যেমন লাগবে- তোমাকেও ক্রিকেট নিয়ে কেউ উপদেশ দিলে তেমনই লাগবে তা আমি জানি! তাই আমি তোমাকে দল নিয়ে কিছুই বলবো না। তোমার টিম, চাইলে ভাংবে চাইলে গড়বে। আমরা শুধু জীবনের হালচাল নিয়ে কথা বলবো। ‘
গম্ভীর জানান, তার ৭ বছরের কেকেআরের নেতৃত্ব চলাকালে সাত মিনিটও ক্রিকেট নিয়ে কথা হয়নি। শুধু একবার ২০১৪ সালে যখন প্রথম পাঁচ ম্যাচে চারটাতে হেরে বসে আছে দল, তার নিজের স্কোর তিনটি শুন্য এবং মাত্র ১ রান, তখন টিম থেকে বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলেন। আর শাহরুখ বলেন, ‘আমাকে কথা দাও, যতদিন তুমি খেলতে চাইবে খেলবে- বিশ্রামের কথা বলবে না।‘ পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে কেকেআর আইপিএল চ্যাম্পিয়নও হয়। গম্ভীরের চমৎকার পারফরম্যান্স আজও তালিকার শীর্ষে এই আলাপের পরে।
২০২৩ সালেও গম্ভীরকে নিজেই দলে ফেরার জন্য আহ্বান জানান। ডেকে কেবল বলেন, চলে আয়.. একেবারে দিল্লী স্টাইলে। ফের শুরু হয়ে যায় গম্ভীর ও কেকেআরের যুগলবন্দী।
এই হলো কেকেআরের সাথে গম্ভীরের আবেগের প্রথম সুতো। এসআরকের ম্যাজিক কথাতে তো আছেই হয়তো, গম্ভীরের ম্যাজিকও নিতান্তই কম নয়। তিনিই একমাত্র প্লেয়ার যিনি অধিনায়ক ও মেন্টর হিসেবে আইপিএল জিতলেন। এবারের আইপিএলের শুরুতেও অকশনে হাসিমুখে যখন মিচেল স্টার্ককে কিনেন ২৫ কোটি টাকা দিয়ে, সে টাকা উশুল হবে কিনা তা নিয়ে ছিল সংশয়। অথচ সেই মিশেলই হলেন ফাইনাল সেরা।
অলরাউন্ডার সুনীল নারিন, আন্দ্রে রাসেল, মণীশ পাণ্ডেকে বয়ষ্ক খেলোয়াড় বলেও কম ঠাট্টা হয়নি। ফিল সল্ট, বিতর্কিত শ্রেয়স আইয়ারকে নিয়েও নানান জল্পনা। সাথে তরুণ কয়েকজন প্লেয়ার এই নিয়েই কেকেআর।
আর মেন্টররূপে গম্ভীর। খেলা নিয়ে গম্ভীর তার নামের মতেই গম্ভীর। কখনো চটে গেছেন সতীর্থ ভিরাট কোহলির উপর। আর তার সতীর্থরা বলেন পাকিস্তানের বিপরীতে সবসময়েই যেন হাল্কের ভূমিকায় থাকেন গম্ভীর। তার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে খেলা। তার মারমুখী আচরণ আবার সমলোচনায় পেয়েছে। সব মেনেই আবার মাঠেও ফিরেছেন।
এবারের ডাকেও তিনি বলেন, ‘আমি আবেগে ভেসে যাই না। কিন্তু আমি সেই জায়গায় ফিরে গিয়েছি, যেখান থেকে সব কিছু শুরু হয়েছিল। আমি শুধু কেকেআরে ফিরছি না। আমি কলকাতায় ফিরছি। জয় ছিনিয়ে নিতে ফিরছি। ‘
তার নেতৃত্ব নিয়ে আগেও কম প্রশংসা হয়নি। ২০১৪ সালে কেকেআরে সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কাজ করা ডব্লিউ ভি রামন বলছিলেন, ‘২০১৪ সালে গম্ভীর যখন কেকেআর ক্যাপ্টেন্সি করছে, তখন ওর স্ট্র্যাটেজি দেখতাম আর অবাক হয়ে যেতাম। তাঁর হাতেই কেন সাফল্য আসে জানেন? কারণ তিনি যা করেন, সৎ ভাবে ভালোবেসে করেন। ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু বোঝেন না গম্ভীর। ক্রিকেট তার কাছে উপাসনার চেয়ে কম নয়। ‘
তবে মান অভিমান হোক বা পরিস্থিতি, কালের পরিক্রমায় ক্রিকেট থেকে অবসরে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হয়ে ভোটের লড়াই করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন গম্ভীর। লোকসভা ভোটের আগেই দায়িত্ব ছাড়েন পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর। ভোটের ঠিক আগেই গম্ভীরকে মেন্টর ঘোষণা করেছিল কেকেআর।
এরপর রাজনৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে অব্যাহতি চান। রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকে সরে এসে ২৬ মে আইপিএলের ফাইনালে জেতানোর জেদ ধরেন এই তরুন নেতা।
এবারের আইপিএল শুরুর আগে গম্ভীর বলেছিলেন, ‘২৬ মে পর্যন্ত আমাদের থাকতে হবে। তার জন্য নিজেদের উজাড় করে দিতে হবে। সেটা আজ থেকেই সকলে শুরু করে দাও। আমাদের প্রত্যেককে এক রকম ভাবতে হবে। একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, তাহলেই সাফল্য আসবে।’ সেই কথা রেখে নিজেদের দুইশতভাগ দিয়েছেন সকল খেলোয়ার। তাদের নিয়ে যত ঠাট্টার অবসান করেছেন নিজেরা লড়ে, খেলে ও জিতে। গম্ভীরও হেসেছেন শেষ জয়ে।
তবেই এই শেষ নয়, শোনা যাচ্ছে রাহুল দ্রাবিড়ের পর ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচের চেয়ারেও তাকে ভাবা হচ্ছে। তবে সেটা এখনও গুঞ্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সত্য হলে শাহরুখ খানের দেয়া দশ বছরের ব্ল্যাংক চেক নাকি হেড কোচের চেয়ার – কোনটিকে বেছে নেবেন গম্ভীর তা সময়ই বলে দেবে।
আপাতত সাফল্য উদযাপনেই না হয় কাটুক গম্ভীরের হালকা সময়। যেভাবে তিনি টিম ডিনারে বসে প্রজেক্টরে ১৭তম আইপিএল আসরের ছোট ছোট মুহুর্ত দেখিয়ে দলকে চাঙা করে রেখেছেন ২৬ মে অবধি- সেই নিয়েই না হয় চর্চা চলুক। চলতে থাকুক তার অনুদানে চলা সুবিধাবঞ্ছিতদের জন্য কমিউনিটি কিচেন। এছাড়াও ভারতীয় সীমান্তে প্রাণ হারানো সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের দেখা-শোনাতেও শোনা যায় গম্ভীরের নাম।
মাঠ ছাড়িয়ে গোটা ভারতের প্রার্থণায় যেন আজ তাই শুধুই গুরু ‘গম্ভীর’, যিনি এবার হেসেছেন, লড়েছেন ও জিতেছেন।