গল্পটা হাঙ্গেরিয়ান নাগরিক আগনেস কেলেটির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি হিটলারের ধংসযজ্ঞ হলোকাস্ট থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেন। আর নতুন জীবন পেয়েই যিনি হেলসিঙ্কি ও মেলবোর্ন অলিম্পিকে জিমন্যাস্টে জেতেন মোট পাঁচটি স্বর্ণ পদক। দীর্ঘ দিন ধরে তিনিই ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। সেই আগনেস কেলেটি অবশেষে হার মানলেন প্রকৃতির কাছে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত ২ জানুয়ারী হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই অদম্য যোদ্ধা। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ১০৩ বছর।
স্থানীয় ক্রীড়া দৈনিক নেমজেতি স্পোর্টকে খবরটি নিশ্চিত করেছেন তার ছেলে রাফায়েল বিরো। পরে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বিষয়টি জানিয়েছেন কেলেটির প্রেস কর্মকর্তা তামাস রোথ।
মায়ের মৃত্যুর খবর জানাতে গিয়ে ছেলে রাফায়েল বিরো স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা তার জন্য প্রার্থনা করি। তার জীবনীশক্তি ছিল অবিশ্বাস্য।’
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি টমাস বাখ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘তিনি (হলোকাস্ট) ট্রাজেডি কাটিয়ে উঠতে দৃঢ় সংকল্প ও অসীম সাহস দেখিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দশটি অলিম্পিক পদক জিতেছেন, যার মধ্যে পাঁচটি সোনা।’
প্রসঙ্গত, ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি ও ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক মিলিয়ে ৫টি সোনাসহ জেতেন ১০টি পদক, সব কটিই ৩০ পেরোনোর পর এবং তার চেয়ে অনেক কম বয়সী প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়ে। হাঙ্গেরির ইতিহাসে সফলতম জিমন্যাস্ট তিনিই।
২০১৬ সালে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগনেস বলেছিলেন, ‘শুধু খেলাধুলা পছন্দ করতাম বলে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি; বরং আমি বিশ্ব ঘুরে দেখতে চেয়েছিলাম।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর পর, অর্থাৎ ১৯২১ সালে ৯ জানুয়ারি ইহুদি পরিবারে জন্ম নেন আগনেস কেলেটি। পরিবার তার নাম রেখেছিল আগনেস ক্লাইন। পরবর্তীতে নিজেই নামের পদবি পরিবর্তন করেন। ক্লাইন থেকে হয়ে যান কেলেটি, যেন তাকে আরও বেশি হাঙ্গেরিয়ান মনে হয়।
কেলেটির জিমন্যাস্টে হাতেখড়ি মাত্র ৪ বছর বয়সে। ১৬ বছর বয়সে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হন আর জাতীয় দলে প্রথমবারের মতো ডাক পান ১৯৩৯ সালে। কিন্তু ইহুদি হওয়ার কারণে ১৯৪০ সালের পর থেকে তাকে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
১৯৪৪ সালের মার্চে নাৎসি বাহিনী হাঙ্গেরি দখল করে। প্রাণে বাঁচতে কেলেটি তখন নিজেকে খ্রিস্টান নারী পরিচয় দেন এবং নিজের কাছে যা কিছু ছিল, সেসবের বিনিময়ে জাল নথিপত্র তৈরি করেন। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নৃশংসতা থেকে নিজে বাঁচতে গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন দীর্ঘদিন, এমনকি করেছেন ঝিয়ের কাজ। আর অবসর সময়ে দানিউব নদীর তীরে গোপনে অনুশীলন করতেন।
১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির ব্যর্থ সোভিয়েত বিরোধী বিদ্রোহের কয়েক সপ্তাহ পর শুরু হয় মেলবোর্ন অলিম্পিক। সেই অলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়া হাঙ্গেরির অনেক অ্যাথলেটের মতো কেলেটিও দেশে ফেরেননি।
পরের বছর তিনি ইসরায়েলে স্থায়ী হন। সেখানে হাঙ্গেরিয়ান ক্রীড়া শিক্ষক রবার্ট বিরোর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৫৯ সালে তারা বিয়ে করেন।
খেলোয়াড়ি জীবন শেষে শিক্ষকতা শুরু করেন আগনেস কেলেটি। শিক্ষকতা জীবনের শুরু করেছিলেন শারীরিক শিক্ষা বিভাগে। পরবর্তীতে ইসরায়েল জাতীয় দলের কোচ হন। ১৯৮৩ সালে বিশ্ব জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপ উপলক্ষে তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট হাঙ্গেরিতে ফেরার অনুমতি পান। ২০১৫ সাল থেকে হাঙ্গেরিতেই বাস করতে শুরু করেন। আর নিজ দেশেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেলেটির একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘পাঁচবারের অলিম্পিক সোনাজয়ী, জাতির শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ, বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন—সবকিছুর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি শান্তিতে থাকুন।’
