বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে সবচেয়ে আইকনিক বছরগুলোর একটি নিঃসন্দেহে ২০১২। সেই বছরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এশিয়া কাপের একাদশ আসর। আয়োজন ছিল ঢাকার মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। এই আসর গোটা প্রজন্মের হৃদয়ে এক স্থায়ী দাগ কেটে গেছে। ক্রিকেট যে মানুষকে কাঁদাতে পারে, তা এদেশের মানুষ যেন প্রথম উপলব্ধি করেছিল ২০১২ সালের এশিয়া কাপের আসরেই। এই আসরেই আবেগে বুক ভাসিয়েছিল সমগ্র জাতি।
এই উন্মাদনার শেকড় অবশ্য আরও কিছুটা পুরোনো। ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ। যদিও ভারত, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবুও সেবার ঢাকায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর জয় যেন নতুন করে রক্তে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ক্রিকেটের উন্মাদনা। ধারাভাষ্যে উচ্চারিত সেই অবিস্মরণীয় বাক্য—“The Bangladesh Tigers have knocked the England Lions out of the World Cup!”—আজও ভেসে বেড়ায় ক্রীড়াপ্রেমীদের কানে।
সেই ধারাবাহিক উন্মাদনা নিয়েই বাংলাদেশ এশিয়া কাপকে স্বাগত জানায় ২০১২ সালে। ১১ মার্চ পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিল টাইগারদের অভিযান। প্রথম ম্যাচেই হোঁচট খায় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের ২৬২ রানের জবাবে বাংলাদেশ অলআউট হয় ২৪১ রানে। তামিম ও সাকিব উভয়েরই ৬৪ রান আর নাসির হোসেনের ৪৭ ছাড়া ব্যাটিং কার্ডে ছিল না উল্লেখযোগ্য কিছু। অনেকেই হয়তো তখনই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু ক্রিকেটের নাটকীয়তা তো অন্য কিছুই লিখে রেখেছিল।
১৬ মার্চ ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা এখনো বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয় অধ্যায়। এই ম্যাচেই শচীন টেন্ডুলকার পূর্ণ করেছিলেন তার আন্তর্জাতিক শততম সেঞ্চুরি। সেটাকে বলা যায় ‘ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম’ মুহূর্ত। কিন্তু দিনের শেষটা ভারত উদ্যাপন করতে পারেনি। তামিমের ৭০ রানের ইনিংস আর সাথে সাকিব ও মুশফিকের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ ৫ উইকেটের জয় ছিনিয়ে নেয়। সেই জয়ের পরেই গোটা জাতি বিশ্বাস করতে শুরু করে, ফাইনাল এখন হাতের নাগালেই।

সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০ মার্চ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় নিশ্চিত করে টাইগাররা প্রথম বারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে নতুন ইতিহাস রচনা করে। লঙ্কানরা গুটিয়ে যায় ২৩২ রানে। তামিম এদিনও করেন ফিফটি। সাকিব, নাসির ও মাহমুদুল্লাহর ব্যাটে ভর করে ৫ উইকেটে জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। দেশের প্রতিটি মানুষ তখন বিশ্বাস করতে শুরু করে যে এবারই হয়তো শিরোপা আসবে বাংলাদেশের ঘরে।
২২ মার্চ, সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত ফাইনালে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। শুরু থেকেই দুর্দান্ত বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে টাইগাররা। ২০৬ রানে ৯ উইকেট পড়ে গেলে শিরোপা প্রায় হাতের মুঠোয় এসেছিল। কিন্তু শাহাদাত হোসেনের শেষ ওভারে পাকিস্তান তোলে ১৯ রান। শেষ পর্যন্ত তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৩৬।

বাংলাদেশের জয়ের লক্ষ্য ২৩৭। তামিমের ধারাবাহিক ফিফটি, সাকিবের ৭২ বলে ৬৮ রানের অসাধারণ ইনিংস ম্যাচটাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। শেষ ওভারে দরকার ছিল ৯ রান আর হাতে ছিল ৩ উইকেট। এজাজ চিমার করা শেষ দুই বলে প্রয়োজন ছিল ৪ রান। কিন্তু রাজ্জাক আউট হলে শেষ বলে চাওয়া ছিল এক বাউন্ডারি। শাহাদাত পারেননি সেই স্বপ্নপূরণে। ম্যাচ হেরে যায় বাংলাদেশ, কিন্তু সেদিন কেঁদেছিল গোটা দেশ। মাঠে থাকা হাজারো দর্শক থেকে শুরু করে টেলিভিশনের সামনে বসা কোটি মানুষ, এমনকি ড্রেসিংরুমের ক্রিকেটাররা সবাই কেঁদেছিল অঝোরে।

সেদিনটি এক প্রজন্মের কাছে থেকে গেছে এক মহাকাব্যিক হৃদয়ভঙ্গের স্মৃতি হিসেবে। এশিয়া কাপ ২০১২ শুধু একটি টুর্নামেন্ট নয়, এটি হয়ে আছে এক হার্টব্রেকের প্রতীক। শিরোপার এত কাছে এসেও স্পর্শ করতে না পারার গ্লানি এখনো তাড়া করে বেড়ায় এদেশের কোটি ক্রিকেটপ্রেমীকে।
১৯৮৪ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয়েছিল এশিয়া কাপ। ১৯৮৬ সালে প্রথম অংশ নেয় বাংলাদেশ। সেই শুরু থেকে ভারত ও শ্রীলঙ্কার আধিপত্যই ছিল চোখে পড়ার মতো। ভারত জিতেছে সর্বোচ্চ আটবার, শ্রীলঙ্কা ছয়বার আর পাকিস্তান দুইবার। বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেছিল দুবার।২০১২ ও ২০১৬ সালের আসরে ফাইনালে গিয়েছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু সেই শিরোপা এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
তবু ২০১২ সালের এশিয়া কাপ বাংলাদেশের জন্য অমর হয়ে আছে। জয় না এলেও ক্রিকেটপ্রেমীদের এক করেছে সেই আসর। আনন্দ ভাগাভাগি করতে না পারলেও দুঃখে বুক ভাসিয়েছিলো সবাই একসাথে। হয়তো এমন দিনের জন্যই বলা হয়, “দিস ইজ মোর দ্যান জাস্ট এ গেম।”
স্কোর কার্ড
বিশ্বকাপ ২০২৩



















