আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের জন্মদিন। ৪২ বছরে পা রাখলেন দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্যাপ্টেন, মাশরাফি বিন মুর্তজা।
বাংলাদেশে ক্রিকেট মানেই আবেগ, আর সেই আবেগের সবচেয়ে প্রিয় নাম মাশরাফি। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য কাজ করা, সবখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন প্রেরণার প্রতীক। কোটি বাংলাদেশির কাছে তিনি এখনো এক অমলিন সুপারহিরো।
রবিউল ইসলাম জীবনের লেখা জনপ্রিয় গান ‘ট্রিবিউট টু মাশরাফি’-তে যেমন বলা হয়েছিল
“সময়ের পোস্টারে লিখে যাও তুমি বাংলাদেশের নাম
হৃদয় গভীর থেকে জানাই তোমায় হাজারও সালাম
তুমি জেতো, তুমি জেতাও, তুমি বোঝো বিজয়ের ভাষা
মাশরাফি, তুমি কোটি প্রাণের আশা,
মাশরাফি, তুমি লাল-সবুজের ভালোবাসা।”
এই কয়েকটি লাইনই যেন মাশরাফি কে নিয়ে পুরো বাংলাদেশের অনুভূতিকে একসঙ্গে বেঁধে ফেলে।
১৯৮৩ সালের ৫ অক্টোবর, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা নড়াইলে জন্ম মাশরাফির। ছোটবেলায় তিনি পড়াশোনার চেয়ে ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন। ফাঁকে ফাঁকে চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটতেন। কৈশোরে ক্রিকেটে আগ্রহ জন্মায়৷ ব্যাটিংয়ের দিকেই মনোযোগ ছিল বেশি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বল হাতে তিনি হয়ে ওঠেন এক বিস্ময়। যেই বিষ্ময়ের নাম -“নড়াইল এক্সপ্রেস”। নিজ শহরে আজও তিনি অতি প্রিয় মুখ। নড়াইলের মানুষ তাকে ভালোবেসে ডাকে- “প্রিন্স অব হার্টস”।
বাংলাদেশ এ দলে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার পরই সুযোগ পান জাতীয় দলে। ২০০১ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয় তার। অভিষেকেই তুলে নেন ৪ উইকেট, প্রথম শিকার ছিলেন গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার। আশ্চর্যের বিষয়, সেটিই ছিল তার প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচও। এটি ছিল বিরল এক অর্জন। ওই মাসেই, ২৩ নভেম্বর, ওডিআইতেও অভিষেক ঘটে। সেদিন ৮ ওভার ২ বলে ২৬ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। শুরু হয় এক দীর্ঘ ও স্মরণীয় পথচলা।
তার ক্যারিয়ারজুড়ে ইনজুরি যেন এক অনিবার্য সঙ্গী। পিঠ, হাঁটু, গোড়ালি প্রতিবারই চোটে পড়েছেন, কিন্তু প্রতিবারই ফিরে এসেছেন। ১৫টিরও বেশি বড় ইনজুরি, ১০টি সার্জারি।তারপরও হাল ছাড়েননি তিনি।২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে বীরত্বপূর্ণ পারফরম্যান্স আর ২০১২ এশিয়া কাপে সফল প্রত্যাবর্তন, প্রতিটি অধ্যায়ে মাশরাফি প্রমাণ করেছেন যে অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তার আসল পরিচয়।
২০০৯ সালে প্রথমবার অধিনায়কত্ব পান, যদিও ইনজুরিতে সেই দায়িত্ব বেশিদিন রাখতে পারেননি। কিন্তু ২০১৪ সালে ফেরেন নতুন রূপে এবং শুরু হয় এক সোনালি অধ্যায়।
তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্জন করে বহু ঐতিহাসিক সাফল্য:
২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল
পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়
২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল
তিনি ছিলেন প্রথম বাংলাদেশি অধিনায়ক যিনি দুই বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আর অধিনায়ক হিসেবেই নিয়েছেন ১০০টির বেশি আন্তর্জাতিক উইকেট।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে টি–টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন মাশরাফি। এরপর ২০২০ সালের মার্চে ওডিআই অধিনায়কত্ব ছাড়েন। শেষ হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক গৌরবময় অধ্যায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি মোট ৩৯০টি উইকেট শিকার করেছেন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রাজনীতির মাঠে পা রাখেন নড়াইলের এই নায়ক। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নড়াইল-২ আসন থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য হিসেবে। মাঠ বদলালেও, মাশরাফি একইভাবে মানুষের পাশে থেকেছেন উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও খেলাধুলায় অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন।
লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘মাশরাফি’ বইয়ে যেমন বলা হয়েছে
“যারা জীবনে লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাদের জন্য মাশরাফির গল্প সাহসের নামান্তর।”
তিনি আরও বলেন,
“অনেকের জীবনে সংগ্রাম আছে, কিন্তু বারবার পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ানোর গল্প খুব কমই আছে। মাশরাফি সেই বিরল চরিত্র।”
আজ মাশরাফির জন্মদিনে কোটি ভক্তের একটাই শুভেচ্ছা
“নড়াইল এক্সপ্রেস, তুমি চলো, আমরা আছি তোমার সঙ্গে।” কারণ, মাশরাফি কেবল একজন ক্রিকেটারই নন, তিনি বাংলাদেশের স্বপ্ন, সাহস আর ভালোবাসার চিরন্তন প্রতীক।
