শুভ জন্মদিন বিরাট কোহলি – ক্রিকেটের কিং অব কিংস
ক্রিকেটের রাজপুত্র কিং কোহলির ৩৮তম জন্মদিন আজ। শুভ জন্মদিন কিং কোহলি – আধুনিক ক্রিকেটের এই রান মেশিন তাঁর অবিশ্বাস্য ব্যাটিং দক্ষতা, নেতৃত্ব ও রেকর্ড ভাঙার ধারায় বিশ্ব ক্রিকেটে এক অনন্য স্থান দখল করেছেন। ভিরাট কোহলিকে জেনারেশনাল সুপারস্টার বললেও ভুল হবে না। নিঃস্বার্থ ভাবে কোটি-কোটি মানুষের ভালোবাসা আর সমর্থন পাওয়ার নজির ক্রিকেট ইতিহাসে খুব একটা নেই। ভিরাট কোহলির আলোচনায় একটা প্রশ্ন আমাদের মনের অজান্তেই মাথায় চলে আসতে পারে। সেটা হচ্ছে, ভিরাট কোহলি স্বয়ং ক্রিকেট খেলার থেকেও বেশি জনপ্রিয় কিনা।
কিছু আইকনিক স্পোর্টস ফিগার কোনো একটা নির্দিষ্ট স্পোর্টসে এসে স্পোর্টসটাকেই বদলে দেয়। মাইকেল জর্ডান, উসাইন বোল্ট, মোহাম্মদ আলী, ম্যারাডোনা, মেসি, রোনালদোরা এই কাতারেই পড়বে। এরা স্পোর্টস থেকে বলতে গেলে সবকিছুই পেয়েছে। তেমনভাবে, এরাও স্পোর্টসকে দুহাত ভরে দিয়েছে। ক্রিকেটের নাম নিলে এই কাতারে আসবে ভিরাট কোহলি। ক্রিকেট দেবতা যেমন সব বর উজার করে দিয়েছে ভিরাটকে, তেমনি ভিরাটও অনেককিছুই ফিরিয়ে দিয়েছে ক্রিকেটকে।

ইতিহাসগতভাবেই ভারতে বড় ক্রিকেটার প্রডিউস হয়। ভারতের ক্রিকেটের লেগাসি শুরু সুনীল গাভাস্কার আর কপিল দেবদের হাত ধরে। এরপর শচীন, সৌরভ, রাহুল দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ, শেহবাগ, যুবরাজরা এই লেগাসি এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে এই জেনারেশনে কিংবা ক্রিকেট ইতিহাসেই হয়তো শচীন টেন্ডুলকার নামটা আনম্যাচড।
বিশ্বকাপ ফাইনাল- ২০১১
২০১১ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন, মালিঙ্গার বলে আউট হয়ে যখন ড্রেসিংরুমের দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন দ্যা গ্রেট শচীন টেন্ডুলকার, ঠিক সেই সময়েই ব্যাটিং করতে মাঠে ঢুকছিলেন ভিরাট কোহলি। সেই সময়ে শচীন ভিরাটকে কিছুটা পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে মাঠ ছাড়ছিলেন আর ভিরাটকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। সেই সময়টি হয়তো শচীন টেন্ডুলকারের জন্য ক্রিকেটের টর্চ-পাসের মুহূর্ত। যেখানে ক্রিকেটের দেবতা তার লেগাসি ক্রিকেটের আগামীর কিং এবং তার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

এর পরের জেনারেশনাল সুপারস্টার ধোনি, রোহিত ও ভিরাটরা। এই সবগুলো নামই ক্রিকেট ইতিহাস এবং ভারতীয় ক্রিকেটে খুবই জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ন নাম। তবে ভিরাট কোহলি যেন সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। একজন ক্রিকেটার হিসেবে সব অর্জনই তিনি পূর্ণ করেছেন। অর্জনের হিসেবে তাকে সর্বকালের সেরা ব্যাটার বললেও একবারে ভুল হবে না। ক্রিকেটার ভিরাট শুধু একজন ক্রিকেটারেই সীমাবদ্ধ নেই এখন আর। কোটি মানুষের কাছে তিনি এক আইকন। সেই আইকনের দিকে তাকিয়ে অগণিত তরুণ বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
ভিরাট কোহলির জন্ম
১৯৮৭ সালের আজকের দিনেই প্রেম ও সরোজ কোহলি দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে সন্তান। কে জানত, সেই ফুটফুটে বাচ্চাটাই বড় হয়ে ক্রিকেটের কিং হবে! তার বাবা পেশায় ছিলেন আইনজীবী। তার জন্ম দিল্লিতেই। মা-বাবা ছাড়া তার পরিবারে ছিল বিকাশ ও ভাবনা নামের বড় দুই ভাই-বোন। মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখা গিয়েছিল ভিরাটের মধ্যে। এই ছোট্ট বয়সেই ভিরাট একটি ক্রিকেট ব্যাট তুলে নিয়ে তার বাবাকে বল করার অনুরোধ করতেন। পরিবার দিল্লীতে থাকায় ১৯৯৮ সালে পশ্চিম দিল্লি ক্রিকেট একাডেমিতে রাজকুমার শর্মার অধীনে অনুশীলন শুরু করেন ভিরাট।

দিল্লির অনূর্ধ্ব ১৫ ও অনূর্ধ্ব ১৭ দলে অসাধারণ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে খুব অল্প বয়সেই নিজেকে তুলে ধরেছিলেন এক রানপিপাসু তরুণ ব্যাটসম্যান হিসেবে ভিরাট। ২০০৬ সালে জাতীয় লিগের এক ম্যাচে ২৫১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেই সবার নজর কাড়েন তিনি। সেই বছরের ২৬ ডিসেম্বর, দিল্লির হয়ে কর্ণাটকের বিপক্ষে রণজি ট্রফির ম্যাচে খেলেন ৯০ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেই দিন থেকেই শুরু হয় ভারতের ভবিষ্যৎ ক্রিকেট কিংবদন্তি হয়ে ওঠার যাত্রা।
আইসিসি অনূর্ধ্ব ১৯
২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে ভারতকে শিরোপা জেতান অধিনায়ক ভিরাট কোহলি। নেতৃত্বগুণ, কৌশলগত বুদ্ধি এবং খেলায় অনন্য দক্ষতায় তিনি দ্রুতই হয়ে ওঠেন ক্রিকেট দুনিয়ার উজ্জ্বল তারকা। শচীন টেন্ডুলকারকে সবসময় নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে মানতেন ভিরাট, যিনি তার কাছে ‘ক্রিকেটের ঈশ্বর’। আরেক প্রেরণার উৎস ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। যার শান্ত নেতৃত্ব এবং কৌশলগত বোধে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ধোনির পরামর্শে নিজেকে গড়ে তুলেছেন বিশ্বের সবচেয়ে ফিট ক্রিকেটারদের একজন হিসেবে। আজ ভিরাট কোহলি শুধু একজন ক্রিকেটার নন, বরং বিশ্বের অ্যাথলেটদের জন্য ফিটনেসের নতুন মানদণ্ড তিনি।
তার বাবা প্রেম কোহলি ছিলেন ছেলের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। কিন্তু মাত্র ১৮ বছর বয়সে ২০০৬ সালে বাবাকে হারান ভিরাট। তবুও পরদিনই মাঠে নেমে খেলেন ৯০ রানের লড়াকু ইনিংস, যা তার মানসিক দৃঢ়তার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।
ভারতের এই রেকর্ডবুকে জায়গা করে নেওয়া ক্রিকেটারের অর্জনের তালিকা দীর্ঘ এবং গৌরবময়। সব অর্জন একসাথে বলা সম্ভব না হলেও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত চোখ বুলিয়ে দেখা যায়।
ভিরাটের অর্জন
- ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটার পুরস্কার
- ২০১৭ সালে পদ্মশ্রী সম্মাননা
- ২০১৮ সালে রাজীব গান্ধী খেলরত্ন পুরস্কার
- আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮২ টি সেঞ্চুরি
- ভারতীয় ব্যাটারদের মধ্যে সর্বাধিক ডাবল সেঞ্চুরি (৭টি)
- ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ও ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ী দলের সদস্য
- ২০১৬ সালের আইপিএলে এক মৌসুমে ৯৭৩ রান ও চারটি সেঞ্চুরি
- টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে ৬৮ ম্যাচে ৪০ জয়ে ভারতের অন্যতম সফল নেতা
- ২০১৮-১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ভারতের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয় তার নেতৃত্বে
- টাইম ম্যাগাজিনের ২০১৮ সালের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় স্থান
- নিজের প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত তরুণ খেলোয়াড়দের সহায়তা
ক্রিকেটের ক্যারিয়ারের সাম্প্রতিক অবস্থা
এই বছরের ১২ই মে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ভিরাট। ভারতের হয়ে ১২৩টি টেস্টে ৪৬.৮৫ গড়ে ৯,২৩৯ রান করেছেন কোহলি। ৩০টি সেঞ্চুরি ও ৩১টি ফিফটি করেছেন তিনি।
২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত বিশ্বকাপ জিতার পরেই টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন ভিরাট। ভারতের জার্সিতে ১২৫টি টি-টোয়েন্টির ১১৭ ইনিংসে ৪৮.৬৯ গড় ও ১৩৭.০৪ স্ট্রাইক রেটে ৪,১৮৮ রান করেছেন তিনি। এই ফরম্যাটে একটি শতক ও সর্বাধিক ৩৮টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন তিনি।

বর্তমানে খেলে যাচ্ছেন শুধু ওয়ানডে ফরম্যাট। চলতি বছরের অক্টোবরেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের ৩ ম্যাচই খেলেছেন ভিরাট। প্রথম দুই ম্যাচে রানের খাতা না খুলতে পারলেও শেষ ম্যাচে খেলেছেন ৮১ বলে অপরাজিত ৭৪ রানের এক ম্যাচ উইনিং ইনিংস। ভক্তরা আশা করছে ২০২৭ বিশ্বকাপ খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবন
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইতালির টাসকানিতে বলিউড তারকা অনুষ্কা শর্মাকে বিয়ে করেন ভিরাট কোহলি। এই তারকা দম্পতির রয়েছে দুটি সন্তান।
ক্রিকেটের বাইরে স্বাস্থ্যকর জীবনধারার প্রচারেও তিনি সমান সক্রিয়। ‘স্টেপাথলন’ নামের বৈশ্বিক ফিটনেস উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত, নিজের ‘ভিরাট কোহলি ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত তরুণ খেলোয়াড়দের সহায়তা করেন। পুমার সঙ্গে যৌথভাবে তার ‘ওয়ান৮’ ব্র্যান্ড বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। ড্রিম–১১, ফারলেনকো, র-প্রেসারি প্রভৃতি স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেছেন, পাশাপাশি নিজের ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘রং” পরিচালনা করেন। নাইকি, অডি, এমআরএফ, পুমা এমন সব শীর্ষ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দূত হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিরাটের রয়েছে বিপুল অনুসারী। সেখানে নিয়মিত তিনি নিজের ট্রেনিং, ফিটনেস রুটিন এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানা মুহূর্ত শেয়ার করেন।
এক স্বপ্নবাজ ছেলেকে থেকে বিশ্ব ক্রিকেটের প্রতীক হয়ে ওঠা ভিরাট কোহলির গল্প আবেগ, অধ্যবসায় এবং সাফল্যের এক অনন্য উদাহরণ। ব্যাটসম্যান, ক্যাপ্টেন আর ইনস্পারেশন সব ভূমিকাতেই তিনি ভারতের গর্ব। শুধু ভারত বললেও ভুল হবে। আর সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে থাকে ভিরাটের দিকে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে শোনা যায় ভিরাটের স্তুতি। তার যাত্রা আজও প্রমাণ করে, প্রকৃত সাফল্য আসে একাগ্রতা এবং ভালোবাসার মিশ্রণে।
স্কোর কার্ড
বিশ্বকাপ ২০২৩



















