ফুটবলার অনেকেই আছেন, কিন্তু ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ফুটবলকে কেবল একটি খেলা নয়, বরং শিল্প, বিশৃঙ্খলা ও ঐশ্বর্যের এক অভূতপূর্ব মিশ্রণে পরিণত করেছিলেন। প্রতি বছরের ৩০ অক্টোবর, অর্থাৎ তার জন্মদিন যেটা কেবল একটি সাধারন তারিখ নয়, বরং ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এটি সেই দিন—যেদিন ফুটবল নিজেই যেন দেবত্বের স্পর্শ পেয়েছিল।
বুয়েনস আয়ার্সের দরিদ্র উপশহর ভিলা ফিওরিতোর মাটির রাস্তায় জন্ম নেওয়া ম্যারাডোনার গল্প এক অনবদ্য মহাকাব্য। সেটি বেঁচে থাকার, সংগ্রামের, বুদ্ধির এবং ফুটবল জাদুর। ছোটবেলায় সবাই তাকে ডাকত ‘এল পেলুসা’—কোঁকড়ানো চুলের ছোট্ট সেই ছেলেটি, যার পায়ের সঙ্গে যেন বলটা জন্মগতভাবে লেগে আছে। শৈশব থেকেই বোঝা গিয়েছিল, এই ছেলেটি শুধু ফুটবল খেলতে জন্মায়নি—খেলাটিকে পুনর্নির্মাণ করতে এসেছে।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে অভিষেক, পরের বছরেই জাতীয় দলে জায়গা। কিন্তু ম্যারাডোনার মাহাত্ম্য সংখ্যায় নয়—মুহূর্তে। তাঁর প্রতিটি ড্রিবল, পাস, ফেইন্ট ছিল বিদ্রোহ, শিল্প আর আবেগের প্রকাশ। প্রতিপক্ষ ছিল শুধু ডিফেন্ডার নয়—দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক বাস্তবতাও।
মেক্সিকো ১৯৮৬: এক মানুষ, এক বিশ্বকাপ
তারপর এল সেই মহাকাব্যিক মঞ্চ—মেক্সিকো বিশ্বকাপ, ১৯৮৬। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুইটি মুহূর্ত তাঁকে ফুটবলের কিংবদন্তির আসনে বসায়। প্রথমটি, ইতিহাসখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’—রেফারির চোখ ফাঁকি দিয়ে হাতে গোল, যা এক দুষ্টুমি থেকে পরিণত হয় কিংবদন্তিতে। আর কয়েক মিনিট পরই ফুটবলের ইতিহাসে লেখা হয় ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’—নিজ অর্ধ থেকে বল নিয়ে পাঁচজন ইংলিশ ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে বিস্ময়কর গোল। চার মিনিটে ফুটবল বিশ্ব দেখেছিল ম্যারাডোনার দুই রূপ—একজন অলৌকিক শিল্পী, আরেকজন বিদ্রোহী।
আর্জেন্টিনার জন্য সেই ম্যাচ ছিল শুধু জয় নয়—ছিল মর্যাদার পুনর্জাগরণ। ফকল্যান্ডস যুদ্ধের পর আহত জাতিকে ম্যারাডোনা একাই যেন ফিরিয়ে দিলেন আত্মমর্যাদা। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপজয় তাই শুধু একটি ট্রফি নয়, বরং এক জাতির গর্বের প্রতীক।
নাপোলির নায়ক
১৯৮৪ সালে যখন তিনি ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন, অনেকে ভেবেছিল ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায় শুরু হচ্ছে। কিন্তু সেটাই ছিল পুনর্জন্ম। নাপোলিকে দুবার সিরি আ চ্যাম্পিয়ন, একবার ইউইএফএ কাপ জয় এনে দেন। দরিদ্র দক্ষিণ ইতালির মানুষদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ত্রাণকর্তা, এক ‘ফুটবল সাধু’। শহরের দেয়াল, গির্জা, রাস্তায় আঁকা হতে থাকে তাঁর প্রতিকৃতি—নেপলসবাসীর কাছে তিনি ঈশ্বরের সমান।
অপূরণীয়তার মধ্যেই পূর্ণতা
সব কিংবদন্তির মতো ম্যারাডোনার জীবনও ছিল বৈপরীত্যে ভরা। খ্যাতি, আসক্তি, রাজনীতি আর ব্যক্তিগত সংগ্রামে জর্জরিত থেকেও তাঁর দীপ্তি কখনো মলিন হয়নি। তিনি প্রমাণ করেছেন—ত্রুটিপূর্ণ মানুষও অলৌকিকতা ঘটাতে পারে। তাঁর অপূর্ণতাই তাঁকে পূর্ণ করেছে, মানবিক করেছে।
অবসরের পর ফুটবল হারায় শুধু একজন খেলোয়াড় নয়—তার সবচেয়ে অনির্দেশ্য কবিকে। অসংখ্য বিতর্ক, অসুস্থতা ও জীবনের ঝড় পেরিয়েও তাঁর চোখের আগুন নিভে যায়নি। কিউবা, দুবাই, মেক্সিকো কিংবা আর্জেন্টিনা—যেখানেই গেছেন, সঙ্গে ছিল সেই জেদ, সেই জ্বালাময়ী আত্মা। তিনি ছিলেন অবহেলিতদের মুখপাত্র, বিদ্রোহের প্রতীক।
২০২০ সালে তাঁর প্রয়াণ ফুটবলকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুতেও তিনি অমর। বুয়েনস আয়ার্স ও নাপোলির দেয়ালে এখনো আঁকা তাঁর ছবি, মুরাল। প্রতিটি প্রজন্ম যখন নাম্বার টেন জার্সি পরে মাঠে নামে, তখনো শোনা যায়—“ভিভা ম্যারাডোনা!”
মেসি হয়তো তাঁর আলো বহন করেছেন, কিন্তু আলোটা জ্বেলে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা নিজেই।
ম্যারাডোনাকে ঘিরে নতুন শ্রদ্ধা: স্মারক মুদ্রা ও স্টেডিয়ামের নামকরণ
ম্যারাডোনার জন্মদিনে এবার এক অনন্য সম্মান জানিয়েছে আর্জেন্টিনা। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করেছে নতুন এক রৌপ্য স্মারক মুদ্রা, যা কিংবদন্তির উত্তরাধিকারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন।
মুদ্রার উল্টো পিঠে চিত্রিত হয়েছে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত দৃশ্য—১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার “গোল অব দ্য সেঞ্চুরি”। সেই একক দৌড়কে ফুটবলের গতিপথের আকারে অঙ্কিত করা হয়েছে। ২০২৬ সালে গোলটির ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই নকশা পেয়েছে বিশেষ তাৎপর্য।
সামনের পিঠে রয়েছে একটি উঠন্ত বলের প্রতীক—আর্জেন্টাইনদের ফুটবলের প্রতি আবেগ ও গর্বের প্রতিচ্ছবি। ব্যাংকের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এই মুদ্রা ফুটবলে আর্জেন্টিনার প্রতিভা, গর্ব ও আত্মার প্রতীক।”
মাত্র ২,৫০০টি মুদ্রা তৈরি করা হয়েছে, ৯২৫ মানের খাঁটি রৌপ্য দিয়ে। ওজন ২৭ গ্রাম, ব্যাস ৪০ মিলিমিটার, মূল্যমান ১০ মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক সংগ্রাহকদের জন্য একই নকশার স্বর্ণমুদ্রাও প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে, আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ঘোষণা দিয়েছে—লা প্লাতার স্টেডিয়ামের নতুন নাম “ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা – ত্রিকাম্পেওনেস দেল মুন্ডো”।
২০২০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর স্টেডিয়ামটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছিল, এবার যুক্ত হয়েছে আর্জেন্টিনার তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবের প্রতীকী শব্দগুচ্ছ “ত্রিকাম্পেওনেস দেল মুন্ডো”।
শুভ জন্মদিন, ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা।
তুমি শুধু ফুটবলের নায়ক নও, ভালোবাসা, বিদ্রোহ আর আশার প্রতীক।
তুমি বেঁচে আছো প্রতিটি হৃদস্পন্দনে, প্রতিটি ড্রিবলে, প্রতিটি স্বপ্নে।
স্কোর কার্ড
বিশ্বকাপ ২০২৩

















