বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে ২৫ বছর – নেই দৃশ্যমান উন্নতি

বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ২৫ বছর

অভিষেকে টেস্টে বাংলাদেশের স্কোয়াড

বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে ২৫ বছর – সাফল্য ও ব্যর্থতার পর্যালোচনা

বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ২৫ বছর পার হয়ে গেছে অভিষেক হওয়ার পর। ২০০০ সালের এইদিনে (১০ নভেম্বর) বিশ্বের দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে মাঠের লড়াই শুরু করে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে ঐতিহাসিক টেস্ট খেলতে নামে টাইগাররা। টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবার দুই বাঙালি অধিনায়ক টস করেন। ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলী আর বাংলাদেশের নাঈমুর রহমান দুর্জয়। সেই টেস্টে চমকপ্রদ কিছু ঘটনার জন্ম দেয় বাংলাদেশ দল যা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।

বাংলাদেশ দল প্রথম ইনিংসেই করে ৪০০ রান। আমিনুল ইসলাম বুলবুল করেন সেঞ্চুরি ও নাঈমুর রহমান দুর্জয় নেন ৬ উইকেট। এ তিনটিই উল্লেখযোগ্য ও অবিস্মরণীয় ঘটনা। তবে সেই ম্যাচ হেরে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু নিজেদের প্রথম টেস্টেই দুর্দান্ত কিছু পারফর্ম্যান্স দেখিয়ে বাংলাদেশ দল ক্রিকেট বিশ্বকে নিজেদের আগমনী বার্তাটা ভালোভাবেই দিয়েছিল। এরপর গুটিকয়েক জয় আসলেও ২৫ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে খুব বেশি উন্নতি আসেনি বাংলাদেশ দলের। কারণ এরপর আরও ১৪ টেস্ট খেলেছে ভারতের বিপক্ষে, আর কখনও বাংলাদেশ দল ৪০০ রানের ইনিংস গড়তে পারেনি! খুব বেশি উন্নতি করতে না পারার এটাই জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতির গ্রাফ ভালো না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ ও  বেশ কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটার আক্ষেপ জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে (২০০০ সাল) টস করতে নামার আগে ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী ও বাংলাদেশ অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দূর্জয়

টেস্টে ২৫ বছর

টেস্টে আজই বাংলাদেশের ২৫ বছর শেষ। ২৫ বছর আগে এদিন ভারতের বিপক্ষে প্রথমবার টেস্ট খেলতে নেমে বাংলাদেশ টস জিতে আগে ব্যাটিং নেয়। আর প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করে পুরো বিশ্বকে চমকে দেয়। বুলবুল ১৪৫ রানের অবিশ্বাস্য একটি ইনিংস খেলেন। হাবিবুল বাশার সুমন করেন ঝকঝকে ৭১ রান। জহির খান, জাভাগাল শ্রীনাথ, অজিত আগারকার ও সুনিল যোশীরা ছিলেন বোলার।

এরপর ভারতের দুর্দান্ত ব্যাটিং লাইনআপকেও বেশি রান করতে দেয়নি বাংলাদেশের বোলাররা। শচীন টেন্ডুলকর, সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড়দের নিয়ে গড়া ব্যাটিং লাইনআপকে ৪২৯ রানেই গুটিয়ে দেন বাংলাদেশের দুর্জয়, মোহাম্মদ রফিক, হাসিবুল হোসেন শান্তরা। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং ব্যর্থতা শেষ পর্যন্ত সেই টেস্টের চতুর্থ দিনই পরাজয় ডেকে আনে।

অবিস্মরণীয় ১৪৫ রানের ইনিংস খেলে বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেকটাকে গৌরবোজ্জ্বল করে তোলেন আমিনুল ইসলাম ‍বুলবুল

টেস্টে প্রথম জয়

প্রথম জয় পেতে প্রায় ৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে। এরপরও পথচলাটা অনেক সময়ই প্রশংসিত হয়েছে। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয় পায় বাংলাদেশ দল। তবে আবার একটি টেস্ট জিততে লেগেছে আরও ৪ বছর। কখনও কখনও হুট করে বাংলাদেশ খুব ভালো খেলেছে, কখনও আবার চরম ব্যর্থতা দেখিয়েছে। এমনকি আফগানিস্তানের মতো নবীন টেস্ট খেলুড়ে দলের কাছেও ঘরের মাটিতে ২০১৯ সালে টেস্ট হেরেছে বাংলাদেশ। তাই ২৫ বছর পেরিয়েও এখন পর্যন্ত আইসিসির টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে ৯ নম্বরে বাংলাদেশের অবস্থান। এখনও আলোচনার টেবিলে পরিকল্পনা আঁটতে হয় টেস্টে উন্নতির জন্য কী কী  করণীয় আছে।

এই দীর্ঘ সময় টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা করা বাংলাদেশ দলের নির্দিষ্ট ১৩টি বছর আছে যে বছরগুলোয় কোনও টেস্ট জিততে পারেনি। সেদিক থেকে ২০২৩ সালটাই সবচেয়ে ভালো গেছে। সে বছর ৪ টেস্ট খেলে ৩টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ, পরাজয় মাত্র ১টি। জয়ের হার ৭৫ শতাংশ। এর চেয়ে বেশি সাফল্যের হার বাংলাদেশের ২৫ বছরের টেস্ট ইতিহাসে আর কোনো বছরেই ছিল না।

ঐতিহাসিক কিছু জয়ও পেয়েছে বাংলাদেশ। সেই জয়গুলো হচ্ছেঃ

*২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়- দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট জয় সেবারই।

*২০১৬ সালে ক্রিকেটের জন্মদাতা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে অবিস্মরণীয় জয়

*২০১৭ সালে কলম্বোয় স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজেদের শততম টেস্টে জয়

*একই বছর (২০১৭) মিরপুরে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়।

*২০২২ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে জয়

*সিলেটে ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়।

*সর্বশেষ গত বছর আগস্টে পাকিস্তান সফরে তাদের বিপক্ষে ২ টেস্টেই জিতে হোয়াইটওয়াশ করা অবিস্মরণীয় এক সাফল্য।

দেশের হয়ে সর্বাধিক ৯৮ টেস্ট খেলা মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বে ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় পায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশের অপূর্ণতা

বড় দলগুলোর মধ্যে শুধু ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই জিততে পারেনি বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে ১৫৪ টেস্ট খেলে মাত্র ২৩ জয়, ১১২টি হার ও ১৯ ড্র বাংলাদেশের টেস্ট পরিসংখ্যান। দলীয় সর্বোচ্চ রান ৬৩৮, গলে ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। সবমিলিয়ে মাত্র ১২টি ৫ শতাধিক রানের সংগ্রহ আছে বাংলাদেশের। আরও ১৮টি ইনিংস আছে ৪০০ রানের বেশি। দেশের হয়ে সর্বাধিক ৯৮ টেস্ট খেলা মুশফিকুর রহিম প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কয়েকদিন বাদেই শততম টেস্ট খেলার গৌরব অর্জন করবেন। তা নতুন এক মাইলফলকে পৌঁছে দেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে।

অবশ্য কোনও নির্দিষ্ট একটি বছরে খুব বেশি টেস্ট খেলেনি বাংলাদেশ। তাই একজন ক্রিকেটারের জন্য ১০০ টেস্ট খেলতে পারা সত্যি কঠিন! ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ১০টি এবং গত বছর ১০ টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছে। এই কম সংখ্যক টেস্ট খেলাকেও অনেকে উন্নতির অন্তরায় হিসেবে দেখেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই উন্নতি না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখেন দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট অবকাঠামোর বেহাল অবস্থাকে। গত ২৫ বছর ধরে এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে এবং বারবার চুলচেরা পর্যালোচনা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যমান রূপ পায়নি সুপরিকল্পিত কোনো পদক্ষেপ। আর সেজন্যই এখনও টেস্টে বাংলাদেশ পিছিয়েই আছে।

Exit mobile version